Pages

জীবন গড়ার একটাই পথ

Friday, August 29, 2014



           অসংখ্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি মহান আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে কোন আবেদন ব্যতীত নিজ দয়ায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উম্মত হিসেবে এ বিশ্ব চরাচরে প্রেরণ করেছেন। বেশুমার দরূদ-সালাম জানাই আমাদের সবচেয়ে আপনজন, সবচেয়ে দরদী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি, যাঁর বদৌলতে আমরা আল্লাহ পাকের পরিচয় লাভ করেছি।  

              এ সুন্দর ধরণী যখন আঁধারের কালো মেঘাচ্ছন্ন ছিল, আঁধারের পথ বেয়ে যুবসমাজ তথা সর্বস্তরের মানুষ যখন ছুটছিল নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে, সত্যের মসনদ যখন অসত্যের খরস্রোতে ভেসে যাচ্ছিল, হত্যা-নৈরাজ্য, চুরি-ডাকাতি আর “জোর যার মুল্লুক তার” এর চর্চা হচ্ছিল পৃথিবীর সর্বত্র। সেই অন্ধকার যুগে আগমন করেন বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। পৃথিবীর এ সংকটময় মুহূর্তে ধ্বংসের অতল তলে নিমজ্জিত অসভ্য জাতিকে সভ্যতার দিকে আহ্বান জানাতে তাঁকে অনেক নির্যাতনের এবং পদে পদে প্রতিকুলতার শিকার হতে হয়েছে। 

         সুদীর্ঘ তেইশ বছর তিনি আল্লাহভোলা মানুষকে আল্লাহর দিকে, ইসলামের দিকে তথা জান্নাতের দিকে আহ্বান করেছেন। তাঁর দাওয়াতের মূল বিষয় ছিল, একমাত্র আল্লাহ পাকের ইবাদত করা। আর ইবাদত হল আল্লাহ পাকের প্রতিটি হুকুম আহকাম মেনে চলা তথা তাঁর সন্তুষ্টির রাস্তায় চলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যহত রাখা। এক কথায় “নেক আমল করা এবং গুনাহের কাজ বর্জন করা”। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, “তুমি হারাম কাজসমূহ বর্জন কর, এতে তুমি সবচেয়ে বেশী ইবাদতকারী হিসাবে বিবেচিত হবে।” হাদীস শরীফে আরো বর্ণিত হয়েছে, ছোট একটি গুনাহ বর্জন করা বনী আদমের সকল নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম।” তবে কোন ব্যক্তি যদি অধিক নফল আদায়ের পাশাপাশি যাবতীয় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে, তাহলে তিনি অবশ্যই প্রশংসার পাত্র হবেন। 

             যে ব্যক্তি গুনাহ বর্জন করে তাকেই মুত্তাকী বলা হয়। এ মুত্তাকী সম্পর্কেই পবিত্র কুরআন ও হাদীসে প্রশংসা ও সুসংবাদ মূলক অনেক বাণী রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, فريق في الجنة وفريق في السعير   অর্থাৎ- এক দল যাবে জান্নাতে। আর অন্য দল যাবে জাহান্নামে। 
আল্লাহ পাক বলেন, اعدت للمتقين   অর্থাৎ- জান্নাত মুত্তাকীদের জন্য তৈরী করা হয়েছে। মুত্তাকীগণ আল্লাহ পাকের বন্ধু এবং তার কাছে অধিক সম্মানিত। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ان اكرمكم عندالله اتقاكم   অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত হল, যে তোমাদের মধ্যে আল্লাহকে অধিক ভয় করে, তথা অধিক তাকওয়া অবলম্বন করে। এ তাকওয়ার উৎস হল অন্তর। 

    হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, التقوي ههنا অর্থাৎ তাকওয়া হল এখানে। এ কথা বলে তিনি বুকের দিকে ইশারা করেন। তথা তাকওয়ার স্থান হল অন্তর। অন্তর পরিশুদ্ধ হলে সব ঠিক। অন্তর পরিশুদ্ধ হলে তার থেকে যে সমস্ত কাজ প্রকাশ পাবে তা হবে শরীয়ত মুতাবেক। কিন্তু অন্তর পরিশুদ্ধ না হলে অর্থাৎ অন্তর পাপ-পঙ্কিলতায় ভরপুর হলে তার থেকে যে সমস্ত কাজ প্রকাশ পাবে তা শরীয়ত বিরোধী হওয়াই স্বাভাবিক। তাই সর্বপ্রথম অন্তর পরিশুদ্ধ করা জরুরি। 
       অপর দিকে অন্তর হল রাজধানী সাদৃশ্য। অন্যান্য অঙ্গÑপ্রত্যঙ্গ যেমন চোখ, মুখ, কান, ইত্যাদি দেশের বর্ডার সাদৃশ্য। যে দেশের বর্ডার এলাকা সংরক্ষিত থাকে না সে দেশের রাজধানীও নিরাপদ থাকে না। তেমনি ভাবে অঙ্গÑপ্রত্যঙ্গ নামক বর্ডার সুরক্ষিত না থাকলে অন্তর নামক রাজধানীও সুরক্ষিত থাকতে পারে না। তাই অন্তরকে সমস্ত গুনাহ থেকে হেফাজতের সাথে সাথে অন্যান্য অঙ্গÑপ্রত্যঙ্গকেও যাবতীয় গুনাহ ও নাফরমানীমূলক কাজ থেকে হেফাজত করা জরুরি। 
            
         যাবতীয় গুনাহ থেকে বাঁচা ও ত্বাকওয়া অর্জনের উপায় সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা একটি সহজ পথ আমাদেরকে বাতলে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, يا ايها الذين أمنوا اتقو الله وكونوا مع الصادقين    অর্থাৎ- হে ঈমানদারগণ ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর (গুনাহ বর্জন কর)। আর (এর পদ্ধতি হল) তোমরা তাকওয়া অবলম্বনকারীদের সঙ্গী হও। তাই গুনাহ বর্জন ও নেক আমল করার একমাত্র পদ্ধতি হল, সোহবতে সালেহীন গ্রহণ করা। কেউ যদি একটি মেশিন তৈরী করে তা হলে মেশিন তৈরীকারী তার উন্নতি অবনতি সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল ধারণা রাখবে। আল্লাহ পাক যেহেতু আমাদের সৃষ্টি কর্তা কাজেই কোন পথে শান্তি, কোন পথে অশান্তি এটা একমাত্র তিনিই জানেন। তাঁর দেয়া পদ্ধতি গ্রহণ করলে অবশ্যই গুনাহমুক্ত শান্তিযুক্ত স্বার্থক জিন্দেগী গঠন করা সম্ভব। আর সেটা হল সোহবতে সালেহীন ও সুহবতে আহ্লুল্লাহ।   

         কেউ যদি কোন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে চায়,  ঐ বিষয়ে পূর্ণতায় পৌঁছতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই ঐ বিষয়ের দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকের সাথে সার্বক্ষণ থাকতে হবে। তার পরামর্শ মোতাবেক চলার মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করতে হবে।  যেমন- ডাক্তার হতে হলে ডাক্তারী বিষয়ে পাশ করার পরও তাকে অনেক দিন যাবত কোন অভিজ্ঞ ডাক্তারের সাথে থাকা জরুরি। কেউ যদি ভাল চালক হতে চায় তাহলে ড্রাইভিং লাইসেন্স লাভের পরও তাকে অবশ্যই কোন ভাল অভিজ্ঞ চালকের সাথে থাকা জরুরি। তেমনিভাবে আল্লাহওয়ালা হতে হলে, আল্লাহকে পেতে হলে অবশ্যই একজন আল্লাহওয়ালার সুহবতে থাকতে হবে।
       হাকীমুল উম্মাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেন, “এই যামানায় আল্লাহওয়ালা লোকের সুহবত ফরযে আইন বলছি এবং এর উপর ফতোয়া দিচ্ছি। হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ. কে একবার বলা হয়েছিল, আপনি ইলমের এ অজস্র স্রোতধারা কোথায় পেয়েছেন ? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, আমি কিতাব চর্চার পাশা পাশি কুতুব (আল্লাহর ওলী) চর্চা অনেক বেশি করেছি। এ জন্যই তোমরা আমাকে এ অবস্থায় দেখতে পাচ্ছ। তিনি প্রায় দেড় হাজারের অধিক অমূল্য গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। 
সুহবতের আশ্চর্যজনক প্রভাব রয়েছে। সামান্য সুহবতের বরকতে আল্লাহভোলা মানুষ আল্লাহওয়ালা লোকে পরিণত হয়ে যায়। জাহেলী যুগের সেই অসভ্য, বর্বর, কলুষিত মানুষগুলোই দোজাহানের বাদশা হযরত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুহবতের বরকতে সর্ব শ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত হয়েছিলেন।
সুহবত বা অন্যের সঙ্গলাভ একটা স্বাভাবিক অভ্যাস। মানুষ মানুষের সাথেই চলবে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের নিকট একটি চিরসত্য কথা হল, “মানুষ একাকী বসবাস করতে পারে না, সে তার বন্ধু চায়” এ কথার ব্যাখ্যায় জনৈক আহ্লুল্লাহ বলেন, আল্লাহ পাক যেন বলতে চাচ্ছেন,  হে মানব জাতি ! তোমাদের স্বভাব হল তোমরা একা একা চলতে পার না বরং একজনের সাথে চলতে চাও। আমিও চাই তোমরা কারো সাথে চল, তবে আমার কাম্য হল, তোমাদের কাছে আমার যে বন্ধু আছে তার সাথে চল। তাঁর মাধ্যমেই তোমরা আমার নৈকট্য লাভ করতে পারবে। জনৈক বুযুর্গ লোক বলেন, নতুন কোন লোক তাবলীগে কিছু দিন সময় কাটানোর পর এলাকায় এসেই মানুষকে নামাযের দিকে, নেক কাজের দিকে আহ্বান জানাতে থাকে, এটাও সুহবতের তা’সীর ও বরকত। কারণ সে আল্লাহর রাস্তায়, আল্লাহওয়ালাদের সাথে কিছুদিন নিজের পূর্ণ সময় ব্যয় করেছে। 

                   কেবল সুহবতের বরকতে সাহাবায়ে কেরাম রা. এমন মর্তবায় পৌঁছেছেন, যে স্তরে পৌঁছা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ তাঁরা শ্রেষ্ঠ মানব রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুহবতে ছিলেন। তাই একবার হাসান বসরী ও আব্দুল্লাহ বিন মুবারক রহ.কে হযরত মুয়াবিয়া রা. এবং হযরত ওমর বিন আব্দুল আযীয রহ. এর মধ্যে কার মর্তবা বেশি এ কথা জিজ্ঞসা করা হলে উভয়ে উত্তর দিয়ে ছিলেন যে, হযরত মুয়াবিয়া রা. যখন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন তখন মুয়াবিয়া রা. এর ঘোড়ার নাকের ভিতর যে ধুলা-ময়লা জমে ছিল তাও হযরত ওমর বিন আব্দুল আযীয হতে উত্তম। এর একমাত্র কারণ হযরত মুয়াবিয়া রা. সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের সুহবত অর্জন করেছেন। 
             সুহবত ব্যতীত আলেমের ইলমও জ্যোতিহীন থাকে। সমাজে তার ইলমের প্রতিফলন কাক্সিক্ষত ও সুন্দর হয় না। এমনকি তার ইলম দ্বারা উপকারের পরিবর্তে সমাজে খারাপ প্রভাব বিস্তার করে। এ সম্পর্কে ডাঃ আব্দুল হাই রহ. এর উপমাটি খুব চমৎকার। তিনি বলেন, উন্নত মানের বিরিয়ানী রান্নার যাতীয় মাল-মসলা একত্রিত করে একটি ডেগে কাঁচা অবস্থায় যদি কিছুদিন রেখে দেয়া হয়, তাহলে সেগুলো পঁচে এত দুর্গন্ধযুক্ত হবে যে, পঁচা দুর্গন্ধে সকলেই অতিষ্ঠ হয়ে পড়বে এবং সর্বত্রই রোগ ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু যদি ডেগের ঐ মাল-মসলাগুলো কোন সুদক্ষ বাবুর্চি আগুন দ্বারা তাপ দিয়ে ঠিকমত নাড়াচাড়া করে তাহলে ঐ বিয়িানীর মৌ মৌ ঘ্রাণে এলাকাবাসী মোহিত হয়ে যাবে। অনুরূপ আলেম ব্যক্তির ছিনার ইলম হল বিরিয়ানীর মাল-মসলার মতো। ইলম নামক মাল-মসলাগুলো যদি আল্লাহ পাকের কোন খাঁটি ওলীর সুহবত নামক নূর  দ্বারা তাপ দেয়া না হয়, তাহলে দুর্গন্ধযুক্ত বিরিয়ানীর উপকরণের মতোই ইলমওয়ালা ব্যক্তি সকলের কাছে ঘৃণ্য, অপদস্ত ও অমর্যাদার পাত্র হয়ে পড়বে। এর দ্বারা নিজেও ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং যারা অনুসরণ করবে তারাও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। 
            আর যদি ইলম নামক মাল-মসলাগুলো আল্লাহ পাকের মাহবূব, মাকবূল বান্দার সুহবতের দ্বারা তাপ দেয়া হয় তাহলে তার ঐ ইলম এমন বরকতময় ও নূরান্বিত হয় যে, সেই নূরের দ্বারা সর্বত্র আলোকিত হয়ে ওঠে। ফলে এর দ্বারা নিজেও উপকৃত হয় এবং অন্যরাও উপকৃত হয়। 
            সুহবতের বরকতে শুধু মানুষই নয় বরং অন্যান্য তুচ্ছ জিনিসেরও দাম অনেক বেড়ে যায়। যেমর- আসহাবে কাহাফের কুকুরটি নেককার লোকদের বরকতে জান্নাতে প্রবেশ করবে। উসতুয়ানা হান্নানা নামক গাছটিও রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বরকতে বেহেশতে প্রবেশ করবে। 
           সুতরাং আল্লাহ পাক রাব্বুল আলমীনকে পেতে আল্লাহ পাকের মনোনীত পদ্ধতি “সুহবতে সালেহীন” অবলম্বন করা সকল মানুষের জন্য জরুরি। বরং জীবন গড়ার এটাই একমাত্র পথ, একটাই পথ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর নৈকট্য অর্জনের জন্য তাঁর প্রিয় বান্দাদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া, তাঁদের সুহবত অর্জন করার তৌফিক দান করুণ। আমীন  

No comments:

Post a Comment

 

NameSilo Coupon Code "discount1$foryou"

like

like
like