প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অবশ্য কর্তব্য হল, ইসলাম ধর্ম পেয়ে গর্ববোধ করা এবং পূর্ণাঙ্গ দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে পালন করা। ইসলামী আকীদা বিশ্বাস, নীতি-নৈতিকতা, কৃষ্টি-কালচার ও আদর্শকে শ্রেষ্ঠ মনে করা এবং এগুলোকে সর্বোতভাবে পালন করার জন্য অত্যন্ত নিষ্ঠবান হওয়া। এরই সাথে বিজাতীয় যে কোন আচার অনুষ্ঠান ও কৃষ্টি-কালচারকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করা।
ইসলাম ধর্ম গোটা মানব জাতির আদর্শ। এটা সর্বদিক দিয়ে পরিপূর্ণ। সে গোটা মানবজাতির উদ্ভুত বিষয় নিয়ে কথা বলে, দিক-নির্দেশনা দেয়। কখনও আদেশ আকারে, কখনও বা নিষেধ আকারে। ইসলামের একটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি বা মূলনীতি হচ্ছে, সর্বদা কাফের, মুশরিক, ইহুদী, নাসারাদের সাথে úূর্ণ বৈষম্য রক্ষা করে চলা। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ-প্রযুক্তি আর টেকনিক্যাল কিছু বিষয় ব্যতীত অন্য সব বিষয়ে বিজাতিদের অনুসরণকে ইসলাম সমর্থ করে না। বলা বাহুল্য, বিজাতিদের অনুসরণ ও অনুকরণ যদি এমন বিষয়ে হয় যা ইসলামের আকীদা-বিশ্বাস, আমল-আখলাক ও নৈতিকতার উপর আঘাত হানে বা আরো অন্যান্য হারামের দিকে ধাবিত করে তাহলে তা সম্পূর্ণ হারাম হিসাবে প্রত্যাখ্যাত। আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রচুর সংখ্যক আয়াত ও হাদীসে এ ধরণের অনুসরণ ও অনুকরণ থেকে মুসলমানদের নিষেধ করেছেন। কিন্তু আজ সজ্ঞানে-অজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় ও অনিচ্ছায় সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অত্যন্ত নগ্নভাবে আমরা তাদের অনুসরণ করছি। এ ভাবে একে একে ইসলামের বক্ষস্থলে কুঠারাঘাত হানছি, যা একজন মুসলমান বা মুসলিম সমাজ কখনো করতে পারে না।
বিজাতিদের অনুসরণের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে নোংরামীর উৎস ১৪ই ফেব্রুয়ারী ‘ভ্যালেনটাইন ডে’-বিশ্ব ভালবাসা দিবস। এ দিবসে খ্রীষ্টীয় সেন্ট ভ্যালেনটাইনের ভালবাসার প্রতি সমর্থন জানিয়ে তার স্মরণে একদল তরুণ/তরুণী আপন ভালবাসার পাত্রকে গোলাপফুল, ভ্যালেনটাইন কার্ড, বিভিন্ন উপহার সামগ্রী উপহার দেয়। বেশ কিছু সংগঠন এ ব্যাপারে ব্যাপক কর্মসূচী পালন করে। এসব কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বিদ্যালয়, স্কুল ইত্যদি জায়গায় ভালবাসা নিয়ে প্রীতি সমাবেশ, রম্য বিতর্ক, প্রেমের গান, প্রেমের কবিতা আবৃত্তি, প্রেমের স্মৃতিচারণ, ব্যা- শো, প্রিন্ট মিডিয়ার বিভিন্ন পত্রিকা প্রকাশ করে ভালবাসার বিশেষ সংখ্যা। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও এ বিষয়ে বিশেষ নাটক সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান ব্যাপকভাবে প্রচার করে। জাতীয় দৈনিকগুলোতেও লাগাতার এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন থাকে। পাশ্চাত্য বিশ্ব খুবই সুকৌশলে আমাদের যুবকদের চরিত্রহীন করার জন্য এ দিবসকে আরো বেশি করে তাদের মত পালন করার জন্য বিভিন্ন প্রকার ফন্দি আঁটে। এরই সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের কতিপয় সাহিত্যিক, কলামিষ্ট, বুদ্ধিজীবীসহ কিছু কিছু পত্রিকা এবং স্যাটেলাই চ্যানেল এই দিবসকে যুব সমাজের সামনে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকে। তারা বিজাতীয় সাংস্কৃতির চর্চার আগ্রহ উস্কে দেয় ।
এক সময় মুর্তি পূজারীরা লুপার কালিয়া নামক দেবতার স্মরণে তরুণীদের নামের লটারী ইস্যু করত। উপস্থিত তরুণী যে তরুণের ভাগে পড়ত সে তাকে ১বৎসরের জন্য ভোগ করত। খ্রীষ্টানরা এসে এ কুপ্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। কারণ তারা ছিল ঐশী কিতাবধারী। তারা এসে তরুণীর নামের পরিবর্তে তরুণের নামের লটারী ধরে এবং দেবতার পরিবর্তে পাদ্রির নাম ঠিক করে। যে তরুণ যে পাদ্রির ভাগে পড়ত সে তরুণকে উক্ত পাদ্রী এক বছর বিশুদ্ধ বা হেদায়েত করার জন্য কাছে রাখত। অবশেষে ৪৭৬ সালে পোপ জিলিয়াস দাবী করলেন দিবসটির নাম পরিবর্তন করার জন্য। অবশেষে রোমান কারারক্ষী মেয়েদের প্রেমে পড়া প্রখ্যাত ধর্মযাজক ভ্যালেনটাইনের নামে ৪৯৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে দিবসটির গোড়া পত্তন হয়। ভ্যালেনটাইন বন্দি থাকা অবস্থায় জেলাবের মেয়েদের প্রেমে পড়েন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার সাথে গল্প করতেন। তিনি মৃত্যুর আগে চিরকুট রেখে যান। তাতে ঋৎড়স ুড়ঁৎ াধষবহঃরহব লেখা ছিল। আর এটাই পরে এই দিনের অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠে। তিনি ১৪ই ফেব্রুয়ারী মারা যান। খ্রীষ্টান সমাজে তাকে প্রেমিকদের যাজক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ভ্যালেনটাই মারা যাওয়ার পর ১৪ই ফেব্রুয়ারী তার মৃত্যু বার্ষিকী পালন করা হয় এবং এই দিনকে ভ্যালেনটাইন ডে নাম রাখা হয়। মোটকথা এই দিনটি মূলতঃ পৌত্তলিকদের কুসংস্কার ও পরবর্তীতে খ্রীষ্টানদের ভ্রষ্টতা থেকেই বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে। ইসলাম অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় মুসলমানদের সকল প্রকার অপসাংস্কৃতি ও কুসংস্কার অনুসরণ করতে নিষেধ করে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য রাখে তার হাশর হবে তাদের সাথে।’ অর্থাৎ- মুসলমানদের সাথে তার হাশর হবে না। বুখারী শরীফে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, অচিরেই এমন সময় আসবে তোমরা তোমাদের পূর্বসুরীদের অনুসরণ করবে প্রতি কদমে কদমে, প্রতি ধাপে ধাপে, এমনকি তারা কোন গুঁই সাপের গর্তে ঢুকে থাকলে তোমরাও তাতে প্রবেশ করবে।’ এ দিবসে যে সব অবৈধ কাজ করা হয়, যে ধরণের অশ্লিলতা উলঙ্গপনার সয়লাভ দেখা যায় এবং যে ধরণের অনৈতিক কার্যকলাপ দেখা যায় তাকে ইসলাম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের ধারের কাছেও যেয়ো না।’ অন্যত্র বলেন, ‘হে রাসূল! আপনি মুমিনদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানকে হেফাযতে রাখে। মুমিন নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন দৃষ্টিকে অবনমিত রাখে এবং লজ্জাস্থানকে হেফাযতে রাখে এবং পর পুরুষের সামনে নিজেদের সৌন্দর্যকে প্রকাশ না করে।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে নিজ জিহ্বা ও লজ্জাস্থানকে সংরক্ষণ করবে আমি তার জান্নাতের দায়িত্ব নেব।’ এই দিবসে তরুণ তরুণীকে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনের প্রতি উৎসাহিত করে তোলে। একে কেন্দ্র করে সামাজিক ও নৈতিক অনেক পদস্খলন, ক্ষতি ও ব্যধি জন্ম নেয়। অল্প বয়সে অপরিনামদর্শী কাজ করার কারণে পরবর্তিতে অনেক কলহ-বিবাদ সৃষ্টি হয় এবং ভবিষ্যতে জীবন নষ্ট করে ফেলে। নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনার সূত্রপাত হয় । এ সময়ে গড়ে উঠা সম্পর্ক পরবর্তীতে স্থায়ী না হলে সে মেয়েকে অপহরণ, মেয়ের চরিত্র হরণ ও মেয়ের উপর এসিড নিক্ষেপ সহ নানা ধরণের অপরাধ ঘটিত হয় । এমনকি এর পরিণতিতে আত্মহত্যার মত জঘণ্য গোনাহের কাজ করার ঘটনাও আমারা মাঝে মাঝেই শুনতে পাই। ইসলাম বিবাহের পূর্বে এ ধরণের অবৈধ সম্পর্ককে সম্পূর্ণ হারাম করেছে।
এক সাহাবী রা. এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে যিনার অনুমতি দেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বুঝিয়ে বললেন, তুমি কি চাও যে, কেউ তোমার মা, বোন ও খালার সাথে যিনা করুক? সাহাবী বললেন, আমি তা চাই না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তদ্রƒপ তুমি যার সাথে যিনা করবে, সেওতো কারো মা, বোন বা খালা হবে। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াাসাল্লাম তার বুকে হাত রেখে তার জন্য দোআ করলেন। এতে তার অন্তর পরি¯ষ্কার হয়ে গেল এবং যিনার দৃঢ়তা দূর হয়ে গেল। এই দিবসের চর্চা যুবক-যুবতীদের হায়া-লজ্জা নষ্ট করে দেয়। অথচ রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। অনুরূপ হাদীসে এসেছে তোমার যদি লজ্জা না থাকে তাহলে তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার। সমাজের মধ্যে লজ্জা না থাকলে তা আর মানুষের সমাজ থাকে না। সে সমাজ পশুর সমাজের চাইতেও নিকৃষ্ট হয়ে যায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমার সকল উম্মত ক্ষমাপ্রাপ্ত।
তবে যারা প্রকাশ্যে গুনাহ করে বেড়ায় তাদেরকে ক্ষমা করা হবে না।’ (নাউযুবিল্লাহ) অনেক সময় অনেক ভদ্র ও ভাল ছেলেরাও বন্ধু-বান্ধব এবং সামাজিক প্রভাবের কারণে নষ্ট হয়ে যায়। এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে এদিবসে দেখা হলে প্রশ্ন করে তুমি কাকে গোলাপ ফুল দিয়েছ ? তখন যদি বলে আমি তো কাউকে গোলাপ ফুল দেই নি। তখন তাকে বলা হয়, তোমার কোন মেয়ে বান্ধবী নেই! সে যদি বলে, না। তখন বলা হয়, এটা কেমন কথা? তোমার ফুল দেবার মত কেউ নাই! এ সকল কথা তার মনে এক ধরণের হিনমন্যতা সৃষ্টি করে। সেও এ ধরণের সম্পর্ক গড়ে তুলতে উৎসাহি হয়। এর পরিণতিতে পিতা-মাতা ও পরিবারের অবাধ্য হয়ে যায় এবং গোটা পরিবারে মুসিবতের কারণ হয়ে দাড়ায়। এ দিবস উদ্যাপনের বৈষয়িক কোন উপকারিতা নেই। বরং এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় হয়। এদিনে একটি গোলাপ ফুল ২০০টাকায়ও বিক্রি হয়। আমেরিকায় এদিনে একটি ফুল ২০/৩০ডলারে বিক্রি হয়। এরূপ চরিত্র বিধ্বংসী নৈতিকতা বিনষ্টকারী যুব সমাজের লাজ-লজ্জা হরণকারী এবং বিভিন্ন প্রকারের অন্যায় অপরাধ ও উচ্ছৃঙ্খলতা সৃষ্টিকারী এ সাংষ্কৃতিকে আমরা মেনে নিতে পরি না। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে কেউ কোন অন্যায় কাজ দেখল, তারপর শক্তি থাকা সত্বেও বাঁধা দিল না তাহলে তার অন্তরে সর্ষে দানা পরিমাণও ঈমান থাকবে না। অন্য হাদীসে ইরশাদ করেন, ‘কারো সামনে কেউ কোন অন্যায় কাজ করলে সে যদি চুপ থাকে তাহলে সে হচ্ছে বোবা শয়তান।’ বোবা শয়তান বলার কারণ হল সে চুপ থাকার দ্বারা অন্যায় কাজ সংঘটিত হওয়াকে সাহায্য করেছে। এইজন্য আমাদেরও এ দিবসে কিছু করণীয় রয়েছে। যে সকল বিষয় আমাদের ঈমান ও সভ্যতার উপর আঘাত হানে তার বিপক্ষে আমরা কখনো নিশ্চুপ থাকতে পরি না। এজন্য আমাদের প্রথম কাজ হল আমরা এ দিবসে যাবতীয় কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকব। কোন উপহার দেব না, কোন অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করব না। আমাদের বন্ধু-বান্ধবদেরকেও বিরত রাখব। স্কুল-কলেজে এ দিবসকে কেন্দ্র করে কোন অনুষ্ঠান যেন না হতে পারে তার জন্য প্রচেষ্টা চালাব। নিজেদের মাঝে এ দিবসের ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা করব। শিক্ষকদের সাথে মতবিনিময় করব। বন্ধু-বান্ধাবদের সাথে পরামর্শ করব। এ দিবসের নানা ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে নিজেদের সন্তান-সন্ততি ও অধিনস্থদেরকে অবহিত করব। যে সকল সংস্থা প্রতিষ্ঠান এ দিবস পালন করে তাদেরকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করব।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, আমাদের সন্তান সন্তুতি ও অধিনস্থদের জন্য আমাদেরকে আল্লাহর দরাবরে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। আমরা যেমন সন্তানদেরকে ইসলামের দিকে পরিচালিত করে সওয়াবের অধিকারী হতে পারি, তেমনি সন্তান-সন্ততিকে কুপথে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করলে অথবা তাদের বিষয়ে গাফলতি প্রদর্শন করলে গোনাহের ভাগী হতে হবে। আল্লাহ আমাদের এসকল কু’প্রথা থেকে বিরত থাকার তাওফীক এনায়েত করুণ। আমীন।
No comments:
Post a Comment